বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ডিজিটাল জরিপ চালু করতে যাচ্ছে সরকার। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী সংসদে মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ডিজিটাল জরিপ কার্যকর হলে পুরনো জরিপ বাতিল হয়ে যাবে। এই ডিজিটাল জরিপ কিভাবে হবে? তাছাড়া পুরনো জরিপ বাতিল হয়ে যাবার অর্থ কী?
বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতির বাইরে এতদিন সনাতন পদ্ধতিতে যে ভূমি জরিপ চলছে তা বন্ধ করার পাশাপাশি ইতোমধ্যে পুরনো পদ্ধতিতে হওয়া সব জরিপ বাতিল হিসেবে গণ্য হবে বলে জানিয়েছেন মি. চৌধুরী।
পরে বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টিকে আরও ব্যাখ্যা করে ভূমিমন্ত্রী জানান, সব জরিপ নয়, সাম্প্রতিককালে যে জরিপগুলো হয়েছে এবং যেসব জরিপ চলমান আছে সেগুলো বন্ধ করতে বলা হয়েছে। যেসব জরিপ আগেই হয়ে গেছে, সেগুলো নয়।
মন্ত্রী বলেন, “আমরা ডিজিটাল জরিপের দিকে যাচ্ছি। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষকে হয়রানিমুক্ত করা। এই জরিপ করতে গিয়ে সমস্যা ও জটিলতা হচ্ছে। সে জন্য আমি বলেছি সাম্প্রতিককালের চলমান জরিপগুলো সব বন্ধ।”
এর আগে মঙ্গলবার সংসদে ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিল, ২০২৩’ পাশের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সার্ভে পর্যায়ক্রমে হবে, এগুলো আসবে। আর ইতোমধ্যে যে সমস্ত জরিপ হয়েছে সব বাতিল। এটা আমি সংসদে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত করতে চাই।’
ফলে চলমান জরিপ যে অবস্থায় রয়েছে সেই অবস্থাতেই বাতিল হবে কী-না সে বিষয়টি মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়নি। খবর বিবিসি বাংলার
তবে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যখন কোন জমির ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হবে, তখন আগের জরিপ বাতিল হয়ে যাবে। ডিজিটাল জরিপ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে জরিপ চলেছে সেটা বহাল থাকবে।
ভূমিমন্ত্রী দাবি করছেন, ডিজিটাল জরিপ কার্যকর হলে ভূমির মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা কমে আসবে। ফলে ভূমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা ও হয়রানিও কমবে।
ডিজিটাল জরিপ কী?
ডিজিটাল পদ্ধতি বা ডিজিটাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ভূমির জরিপ পরিচালনাকে ডিজিটাল সার্ভে বলা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ডিজিটাল জরিপের মাধ্যমে খুব সহজেই জমি পরিমাপ করা যাবে এবং একই সাথে জমির মালিকানা ও মাপের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
এই অঞ্চলে প্রথম ভূমি জরিপ শুরু হয়েছিল ১৮৮৮ সালে কক্সবাজার জেলার রামু থেকে। ওই জরিপের নামকরণ করা হয় ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা সিএস জরিপ। এই জরিপ শেষ হয় ১৯৪০ সালে দিনাজপুর জেলায়।
এরপর ধাপে ধাপে স্টেট একুইজিশন সার্ভে- এসএ (জমিদারি অধিগ্রহণ জরিপ), পাকিস্তান সার্ভে- পিএস, রিভিশনাল সার্ভে- আরএস এবং সবশেষ বাংলাদেশ সার্ভে- বিএস জরিপ সম্পন্ন হয়।
পুরনো পদ্ধতির জরিপে ফিতা টেনে দিয়ে জমির মাপ নিয়ে ম্যাপ তৈরি করা হতো।
ইতোমধ্যে পটুয়াখালী ও বরগুনাতে ডিজিটাল জরিপের পাইলট প্রোগ্রাম চলছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশন, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও ধামরাইয়ে এই ডিজিটাল জরিপের কাজ চলছে বলে অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
কর্মকর্তারা বলছেন, এটি সফল হলে এই জরিপের ওপর ভিত্তি করে সারা দেশে ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সারা দেশে ডিজিটাল জরিপের সক্ষমতা অর্জনে গত বছর এক হাজার তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদি ডিজিটাল সার্ভের উদ্যোগ নেয়া হয়।
তিনটি পার্বত্য জেলা ছাড়া দেশের ৪৭০টি উপজেলার মৌজা পর্যায়ে জিওডেটিক সার্ভের মাধ্যমে ২ লাখ ৬০ হাজার ৩১০টি জিও-রেফারেন্সিং পয়েন্ট নির্ধারণ করা হবে ও ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৮৮টি মৌজা ম্যাপের ডাটাবেজ প্রস্তুত করা হবে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত জমির মানচিত্র ও রেকর্ড সমন্বয় করা হবে। এতে ভূমি মালিক ওয়েবসাইটে গেলে ম্যাপ ও খতিয়ান দুটি একসাথে পেয়ে যাবেন।
এজন্য ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হচ্ছে। সকল ডাটা ক্লাউড বেইজ সার্ভারে সংরক্ষণ করা হবে।
আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে কাজ হবে
এদিকে, নির্ভুলভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করতে বাংলাদেশ ভূমি জরিপ করতে গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম, ফোর্থ জেনারেশন সার্ভে ড্রোন বা ইউএভি, গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন সেইসাথে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম- জিপিএস, ইলেকট্রনিক টোটাল স্টেশন- ইটিএস, ডাটা রেকর্ডার, প্লটার ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা জানিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
আপাতত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ড্রোন উড়িয়ে জমির পূর্ণ ছবি ধারণ করা হবে। স্যাটেলাইট ইমেজিং-এর মাধ্যমে জমির অবস্থান ও মাপ নিশ্চিত করা হবে।
স্যাটেলাইট ইমেজ কিনে সেটা মৌজা ম্যাপের সাথে সমন্বয় করে ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ তৈরি করা হবে। এর ফলে কৃষিজমি, জলাভূমি, পাহাড় ও বনভূমি রক্ষাসহ জমির পরিকল্পিত ব্যবহার করাও সম্ভব হবে।
এছাড়া ইটিএস এর মাধ্যমে জমির নির্ভুল পরিমাপ বা প্লট ভাগ করা হবে। প্লট টু প্লট জরিপ সম্পন্ন হলে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানার তথ্যটি সহজেই জানা যাবে।
ভূমিতে পূর্বে জরিপ করা থাকলে উক্ত জরিপের ডিজিটাইজ ম্যাপের সাথে নতুন প্রস্তুত ম্যাপের সুপার ইম্পোজের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে নতুন জিও রেফারেন্স মৌজা ম্যাপ।
এছাড়া পরবর্তীতে ‘মৌজা ও প্লট ভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্প’ -থেকে সংগ্রহ করা স্যাটেলাইট ইমেজের সাথেও সমন্বয় করা হবে এই মৌজা ম্যাপ।
বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের মূল উদ্দেশ্য অল্প সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে তথা ভূ-সম্পদ জরিপ শেষ করা।
এ ধরণের জরিপে জমির পরিমাণ, জমির আইলের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, আকার ইত্যাদির পুঙ্খানুপুঙ্খ মাপ সম্পর্কে জানা যাবে এবং পরিমাপে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
জরিপ অধিদপ্তর বলছে, একবার ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হলে প্রাকৃতিক কারণে বড় ধরনের ভূমির বিচ্যুতি ছাড়া মাঠে গিয়ে বার বার জরিপ করার প্রয়োজন হবে না।
একই সঙ্গে অনলাইনে মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান একসাথে পাওয়া যাবে।
ভূমি জরিপ অধিদপ্তর আশা করছে এতে ভূমি ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন হবে, আদালতের মামলা কমবে, সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভূমি জরিপের ধাপসমূহ
বর্তমানে ভূমি জরিপ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত কোন এলাকায় ডিজিটাল জরিপ শুরু করার আগে সেখানকার পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে না হলে মাইকিং করে এ বিষয়ে প্রচার প্রচারণা চালানো হয় এবং ব্যাপক জনসংযোগ করা হয়।
এর মাধ্যমে মূলত সেখানকার জমির মালিকদের জানানো হয়। তারা যে নিজ নিজ জমির সীমানা চিহ্নিত করেন এবং জমির মালিকানার কাগজপত্র যেমন – দলিল, নামজারি ও খাজনা পরিশোধ কাগজপত্র হালনাগাদ অবস্থায় কাছে রাখেন।
এর মাধ্যমে ওই ব্যক্তির জমির তথ্য যাচাই বাছাই করা হবে। কোন সমস্যা না থাকলে মালিকানার তথ্য অনলাইনে এন্ট্রি করা হবে।
পুরনো পদ্ধতির জরিপে দেখা যেতো একটি খতিয়ানের একাধিক মালিক রয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেই সুযোগ আর থাকছে না।
ডিজিটাল জরিপে নতুন করে মৌজা নকশা প্রস্তুত করা হতে পারে। যা ট্রাভার্স সার্ভে নামে পরিচিত। স্যাটেলাইন ইমেজের মাধ্যমে মৌজার অবস্থান চিহ্নিত করা হবে। এরপর মৌজার ম্যাপ বা নকশাটি ডিজিটাল পদ্ধতিতে আঁকা হবে। একে কিস্তায়ার বলা হয়।
এই মৌজা ম্যাপে ডিজিটাল পদ্ধতিতে একেকজন মালিকের ভূমিতে আলাদা আলাদা দাগ নম্বর টানা হয়।
জরিপ কর্মকর্তারা মালিকের রেকর্ড, দলিলপত্র ও দখল যাচাই করে মালিকের নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করেন। এই রেকর্ড প্রস্তুত করাকে খানাপুরী বলা হয়।
এই স্তরে ভূমি মালিকদের কাজ হচ্ছে জরিপ কর্মকর্তাদের কাছে জমির মালিকানা ও দখল সংক্রান্ত প্রমাণাদি উপস্থাপন করা।
জরিপ কর্মকর্তারা, এই প্রস্তুত করা রেকর্ড, জমির খতিয়ান বা মাঠ পর্চা সংশ্লিষ্ট ভূমি মালিকদের বুঝিয়ে দেন। এই কাজটিকে বলা হয় বুঝারত।
এই কাগজপত্র কবে বুঝিয়ে দেয়া হবে, সেটা নোটিশ/ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার/ এলাকায় মাইকিং এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়।
এই স্তরে ভূমি মালিকদের কাজ হল ওইসব কাগজপত্রে দেয়া তথ্য ঠিকঠাক আছে কিনা তা যাচাই করা। কোথাও কোন সংশোধন বা পরিবর্তন প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট ডিসপিউট ফরম পূরণ করে তা জরিপ কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়ে কিংবা অনলাইনেও সংশোধন করে নিতে হবে।
পরে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা শুনানির মাধ্যমে দ্রুত বিবাদ নিষ্পত্তি করে জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেন।
এরপর সেই কাগজপত্র একজন রাজস্ব কর্মকর্তা যাচাই বাছাই করে সত্যায়ন করেন। একে তসদিক বলা হয়। এখানেও কোন ভুল থাকলে সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।
তসদিককৃত পর্চা বা সত্যায়িত কাগজপত্র জমির মালিকানার প্রাথমিক আইনগত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এ স্তরের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এরপর ভূমি মালিকদের নামের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী খতিয়ান বা পর্চার নতুন নম্বর দেওয়া হয়। একে খসড়া প্রকাশনা নম্বর বলা। এই খসড়া প্রকাশনার কোন তথ্য নিয়ে আপত্তি থাকলে তখন আপত্তি মামলা দায়ের করতে হয়।
আপীল শুনানি ও চূড়ান্ত রায়ের ভিত্তিতে খতিয়ান ও ম্যাপ চূড়ান্ত প্রকাশনা দেওয়া হয়। এই হালনাগাদ তথ্যের বিবরন অনলাইনে পাওয়া যাবে।